আজগর সালেহী, ব্যুরোচীফ চট্টগ্রাম।
২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল ফটিকছড়ি উপজেলার ভূজপুরে সংঘটিত এক নৃশংস ঘটনার পরবর্তী ১১ বছর ধরে মামলার ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি এবং নির্যাতনের মাধ্যমে অসংখ্য পরিবারকে নিঃস্ব করার অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এটিএম পেয়ারুল ইসলাম এবং সন্ত্রাসী আবু তৈয়বের নেতৃত্বে এই অপতৎপরতা চালানো হয়েছে বলে ভুক্তভোগীরা দাবি করেছেন।
ঘটনার সূত্রপাত ১৩ সালের ১১ এপ্রিল জামায়াতে ইসলামীর ডাকা হরতালের মধ্যে জামায়াত বিরোধী শোডাউনের সময়।
র্যাব-পুলিশের সাবেক তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী আবু তৈয়ব, আবদুল কৈয়ূম, মহিউদ্দিন, চুন্নু, জানে আলম, আবদুল হালিম, ফারুক, আব্বাস উদ্দিন, কামাল উদ্দিন তৈয়ব বাহিনীর শীর্ষ ক্যাডারদের নিয়ে ভয়ংকর অগ্নী অস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র সহ ৫০০-র বেশি মোটরসাইকেল, বাস-মিনিবাস এবং ট্রাকে করে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা ভূজপুর সদরের কাজিরহাট বাজারে প্রবেশ করে। সেখান থেকে তৎকালীন হেফাজত আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফি এবং আলেম-ওলামাদের নিয়ে কটূক্তিমূলক স্লোগান দিলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
একপর্যায়ে কাজিরহাট বাজার মসজিদে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে, মসজিদে থাকা মুসুল্লিরা মাইকে ঘোষণা দেন যে মসজিদ আক্রান্ত হয়েছে। এই ঘোষণা দ্রুত আশেপাশের মসজিদে ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয়রা প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
ঐদিনের ঘটনায় পাঁচটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় ১৬,৪৭১ জনকে আসামি করা হয়, যার মধ্যে ৪৭১ জনের নাম উল্লেখ থাকলেও বাকিরা অজ্ঞাতনামা। এই মামলাগুলোকে পুঁজি করে স্থানীয়ভাবে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি চালানোর অভিযোগ আছে এটিএম পেয়ারুল ইসলাম ও সন্ত্রাসী আবু তৈয়বের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ রয়েছে, এটিএম পেয়ারুল ইসলাম এবং আবু তৈয়ব মামলার ভয় দেখিয়ে পুরো উপজেলায় চাঁদাবাজি চালিয়েছেন। এ কাজে তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন তরিকত, আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের অন্তর্ভুক্ত উপজেলার বিশেষ করে ভূজপুরের কর্মী সমর্থকরা। তাদের মধ্যে ছিলেন লোকমান (ল্যাংড়া লোকমান), এরশাদ, কসাই মান্নান (লন্ডা মান্নান), তাফস বাবু (ইয়াবা বাবু), পরিমল মেম্বার, আলী আবছার (সন্ত্রাসী আবছার), সেলিম জাহাঙ্গীর টিপু, মনজুরুল ইসলাম বাপ্পা, হামিদ মেম্বার, আরিফ মেম্বার, শাহআলম মেম্বার, মুরাদ, মুমিন, সেকান্দর, বাদশা, জুয়েল, আবুল কালাম, সুলেমান, রেজাউল করিম নয়ন, আমান উল্লাহ, খোরশেদ, আনছার এবং ইয়াসিন।
তাদের কার্যক্রমে স্থানীয়রা এতটাই ভীত ছিল যে, ২০১৩ সালের ঘটনার পর তিন বছর এলাকায় আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য কোনো পুরুষ প্রকাশ্যে থাকতে পারেনি। বনে জঙ্গলে, ধানক্ষেতে রাত কাটিয়েছে হাজার হাজার মানুষ।
ঘটনা উপজেলার ভূজপুরে সংঘটিত হলেও, গোটা চট্টগ্রাম থেকে বাঁচাই করে বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজতের সক্রিয় কর্মীদের আসামি করা হয়েছে।
মোহাম্মদ তছলিম মেম্বার বলেন, "শারীরিক নির্যাতন, হাজিরা এবং পালিয়ে থাকতে থাকতে ব্যবসা-বাণিজ্য হারিয়ে এখন পথের ফকির হয়েছি। আমরা দ্রুত মামলা প্রত্যাহার এবং ক্ষতিপূরণ চাই।"
মোহাম্মদ জাহেদ মেম্বার বলেন, "জামিনের পরেও আমাকে গ্রেপ্তার করে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। আমি এখনো এই মামলার ফাঁদে পড়ে আছি। সপ্তাহের চারদিন এখনো হাজিরা দিতে হচ্ছে।"
মাওলানা আইয়ুব বলেন, "আমাদের ঘর থেকে ৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। পরিবারের সবাই পালিয়ে থাকতে থাকতে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। জামিন নিয়ে বাহিরে আসলে আবার নতুন মামলা দিয়ে ধরিয়ে দেওয়া হতো। এমন নির্যাতন আর কোনো পরিবারে হয়নি।"
মামলার প্রধান অভিযুক্ত সাবেক তিনবারের চেয়ারম্যান মাওলানা শফিউল আলম নূরী বলেন, "আমার জীবনের সবকিছু শেষ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। চেয়ারম্যানি, ব্যবসা-বাণিজ্য এমনকি কৃষি জমি পর্যন্ত তারা দখল করে খেয়েছে। এখনো প্রতিদিন হাজিরা দিতে হচ্ছে।" তিনি দ্রুত মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান।
আবু তৈয়ব একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত, তার বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি সহ ৩৬টি মামলার আসামি ছিলো তৈয়ব।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে ফটিকছড়ির ২০ ইউনিয়নের প্রায় ছয় লাখ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে তৈয়ব বাহিনীর কাছে জিম্মি ছিল। তাদের হাতে ছিল একে-৪৭, এম-১৬, জি-৩সহ ভারী বিভিন্ন অস্ত্র।
তৈয়ব এতই ভয়ংকর ছিলেন যে ১৯৯৮ সালে নিজ সংগঠনের নেতা রাশেদুল আনোয়ার টিপুকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা এবং ২০২১ সালে নানপুর সেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল কামালকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি ভারত থেকে ফিরে আসেন এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তার মামলা প্রত্যাহার করিয়ে নেন। গুঞ্জন রয়েছে, চাঁদাবাজি থেকে অর্জিত অর্থ দিয়ে তিনি ভারতের সাবরুম বাজারে সম্পদ গড়ে তুলেছেন এবং স্থানীয়ভাবে "রতন বাবু" নামে পরিচিত।
আবু তৈয়ব এতোটাই ভয়ংকর ছিলো যে, তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে সাহস যেতোনা৷ এমন কি তার দলের লোকজনও ভয়ে তটস্থ থাকতো। ২০১৮ এর ডামি নির্বাচনে প্রভাব কাটিয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান হন দুর্ধর্ষ এই সন্ত্রাসী।
তার বিরুদ্ধে একসময়ের তার পার্টনার এটিএম পেয়ারুল ইসলাম খোদ সভাসমাবেশ সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি ও আওয়ামী কর্মী হত্যার অভিযোগ তুলেছেন একাধিকবার।
ভূজপুর ঘটনা নিয়েও দৈনিক প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ সহ আওয়ামী পন্থী পত্রিকাগুলো ধারাবাহিক মিথ্যাচার করেছিলো।
বানোয়াট কল্পকাহিনী বানিয়ে জামায়াত হেফাজত ও বিএনপিকে জড়িয়ে মুখরোচক সংবাদ পরিবেশন করে পরিস্থিতি কে আরো ঘোলাটে করেছিলো।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলো দ্রুত মামলা প্রত্যাহার, ক্ষতিপূরণ এবং চাঁদাবাজিতে অভিযুক্ত আওয়ামীলীগের সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। প্রশাসনের প্রতি তাদের আহ্বান, এসব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সুবিচার নিশ্চিত করা হোক।