লেখক: সাংবাদিক মাওলানা আসগর সালেহী
ইসলাম উপমহাদেশে এসেছে পীর-আউলিয়াদের মাধ্যমে। তাঁরা শুধু ধর্মপ্রচারক ছিলেন না, বরং সমাজ সংস্কারক হিসেবেও কাজ করেছেন। পীর-আউলিয়ারা দাওয়াত, আধ্যাত্মিকতা, শিক্ষা এবং ন্যায়বিচার প্রচারের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে ইসলামের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন। সুফিবাদ ছিল তাঁদের অন্যতম হাতিয়ার, যার মাধ্যমে তাঁরা ভালোবাসা, সহনশীলতা ও মানবিকতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এভাবেই ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক জটিলতা মোকাবিলা করে ইসলাম উপমহাদেশে দৃঢ় অবস্থান গড়ে তোলে।
চরমোনাই দরবার: ইসলামের প্রচার ও আত্মশুদ্ধির কেন্দ্র
ইসলামের প্রচার ও পথভোলা মানুষদের দীনের সাথে সম্পৃক্ত করার জন্য চরমোনাই দরবার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়; বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ আন্দোলন, যা মানুষের আত্মশুদ্ধি, ধর্মীয় শিক্ষা এবং সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
চরমোনাই দরবার বরিশাল জেলার কীর্তনখোলা নদীর তীরের চরমোনাই ইউনিয়নের কারিমাবাদ গ্রামে অবস্থিত।
মিশন: আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মুত্তাকি ও আল্লাহওয়ালা গঠন
চরমোনাই দরবারের মূল লক্ষ্য হলো আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহমুখী করা। কুরআন ও হাদিসে আত্মশুদ্ধির গুরুত্ব অপরিসীম। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন— "নিশ্চয়ই আমি উত্তম চরিত্র পরিপূর্ণ করতে পাঠানো হয়েছি।" (আল-মুওয়াত্তা)
আত্মশুদ্ধি শুধু ব্যক্তিগত উন্নতির জন্য নয়; এটি সমাজ পরিবর্তনের অন্যতম চালিকা শক্তি। ব্যক্তির আত্মিক উন্নতি হলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই চরমোনাই দরবার মানুষের চরিত্র গঠনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়।
আধ্যাত্মিকতার অভাব: সমাজের অবক্ষয়ের মূল কারণ
আজকের সমাজে আমরা যে ভয়াবহ অবক্ষয়ের সাক্ষী হচ্ছি—রাজনৈতিক হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি, খুনাখুনি, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, গুম, অর্থ পাচার, দেশের সম্পদ লুটপাট, ক্যাম্পাসে অস্ত্রের মহড়া—এসব কেবলই একটি বিষয়কে ইঙ্গিত করে: মানুষের অন্তরে আধ্যাত্মিকতার অভাব এবং আল্লাহর ভয় না থাকা।
যখন কোনো সমাজ থেকে নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ হারিয়ে যায়, তখন সেখানে অন্যায় ও অনাচার স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। মানুষ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যে কোনো উপায় অবলম্বন করতে দ্বিধাবোধ করে না। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, ক্ষমতার লোভ, অর্থের মোহ—এসবই মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত করে। ফলে সমাজে অস্থিরতা, হানাহানি এবং নৈতিক অধঃপতন দেখা দেয়।
একটি সুস্থ সমাজ বিনির্মাণের জন্য প্রয়োজন ন্যায়বোধ, সততা ও আধ্যাত্মিকতার চর্চা। ব্যক্তি, পরিবার ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যদি আল্লাহভীতি, নৈতিক শিক্ষা এবং মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা যায়, তাহলে সমাজের এই ভয়াবহ অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব। তাই আমাদের সবার উচিত আত্মশুদ্ধি, সঠিক ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন ও সত্যের পথে অবিচল থাকার জন্য সচেষ্ট হওয়া।
দরবারের প্রতিষ্ঠাতা ও উত্তরসূরিরা
চরমোনাই দরবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হযরত মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ ইসহাক (রহ.)। তিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক কেন্দ্র উজানীর দরবারের পীর হযরত মাওলানা কারি ইব্রাহিম (রহ.)-এর অন্যতম খলিফা ছিলেন।
পরবর্তীতে দরবারের দ্বিতীয় পীর হন আরেফবিল্লাহ হযরত মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ ফজলুল করিম (রহ.)। তাঁর সময়েই চরমোনাই দরবার সারাদেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক খ্যাতি লাভ করে। তিনি দরবারকে একটি সুপরিকল্পিত ও দীর্ঘমেয়াদি মিশনে রূপান্তর করেন।
বর্তমানে চরমোনাই দরবারের পীর হিসেবে আছেন
হযরত মাওলানা মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করিম (দামাত বারাকাতুহুম) এবং মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়জুল করিম কাসেমী (হাফিজাহুল্লাহ) দ্বিতীয় শায়খ হিসেবে দ্বীনের খেদমতে নিয়োজিত রয়েছেন। উভয়ের প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও অভিজ্ঞতা তাদের নেতৃত্বকে দৃঢ় ও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। ইসলাম, আধ্যাত্মিকতা ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে তাদের অবদান অতুলনীয়। তাদের দিকনির্দেশনা ও প্রজ্ঞার আলোকে অসংখ্য মানুষ সঠিক পথের দিশা পাচ্ছেন এবং ইসলামের সুমহান আদর্শ বাস্তবায়নে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন।
চরমোনাই দরবারের চার মৌলিক স্তম্ভ: বিশ্লেষণ
ফজলুল করিম (রহ.) চারটি মৌলিক বিষয়ের ভিত্তিতে চরমোনাই আন্দোলনকে গড়ে তোলেন—
১. দাওয়াত (তাবলীগ) ২. তা'লীম (শিক্ষা) ৩. তাযকিয়া (আত্মশুদ্ধি) ৪. জিহাদ (বিপ্লব)
১. দাওয়াত (তাবলীগ): ইসলামের বার্তা প্রচার
দাওয়াত ইসলামের মূল দিকগুলোর একটি। রাসূল (সা.)-এর মক্কী জীবন ছিল মূলত দাওয়াতের জীবন। চরমোনাই দরবারের অনুসারীরা দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় দাওয়াতি কাজ করে। কুরআনে বলা হয়েছে— "তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান জানাবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে।" (সুরা আল-ইমরান: ১০৪)
২. তা'লীম (শিক্ষা): জ্ঞানার্জনের অপরিহার্যতা
চরমোনাই দরবার শিক্ষাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ইসলামি জ্ঞানার্জন ছাড়া প্রকৃত দ্বীনদারি সম্ভব নয়। রাসূল (সা.) বলেছেন— "জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরজ।" (ইবনে মাজাহ, হাদিস ২২৪)
চরমোনাই দরবারের অধীনে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানসমূহ:
চরমোনাই আলিয়া ও কওমি মাদ্রাসা
বাংলাদেশ কোরআন শিক্ষা বোর্ড
অসংখ্য হাফেজি ও নূরানি মাদ্রাসা
৩. তাযকিয়া (আত্মশুদ্ধি): চরিত্র গঠনের প্রক্রিয়া
আত্মশুদ্ধি ছাড়া দীনদার হওয়া সম্ভব নয়। কুরআনে আল্লাহ বলেন— "যে নিজেকে পবিত্র করল, সে সফলকাম হলো।" (সুরা আশ-শামস: ৯)
চরমোনাই দরবার আত্মশুদ্ধিকে অন্যতম ভিত্তি ধরে পরিচালিত হয়। সারাবছর বিভিন্ন হালকা, মাহফিল ও তালিমি প্রোগ্রামের মাধ্যমে মানুষকে সংযম, নামাজ, রোজা, পরোপকার ও আধ্যাত্মিক উন্নতির শিক্ষা দেওয়া হয়।
৪. জি'হা'দ (বিপ্লব): ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম
চরমোনাই দরবার ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে বিশ্বাসী। তাই তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য কাজ করে। ইসলামের শত্রুরা সর্বদা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, তাই তাদের মোকাবিলা করা অপরিহার্য।
কুরআনে বলা হয়েছে— "যারা আমার পথে সংগ্রাম করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব।" (সুরা আল-আনকাবুত: ৬৯)
রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জীবন: দাওয়াত, তা'লীম, আত্মশুদ্ধি ও জিহাদের অনুপম দৃষ্টান্ত
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পূর্ণাঙ্গ জীবন পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, তাঁর ৬৩ বছরের জীবনের মূল কার্যক্রম ছিল চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর ভিত্তি করে—দাওয়াত, তা'লীম, আত্মশুদ্ধি ও জি'হা'দ।
প্রথমত, দাওয়াত: তিনি মানুষকে তাওহিদের দিকে আহ্বান করেছেন, শিরক থেকে মুক্ত হয়ে এক আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কঠিন প্রতিকূলতার মাঝেও তিনি কখনো দাওয়াতি কার্যক্রম থেকে পিছপা হননি।
দ্বিতীয়ত, তা'লীম (শিক্ষাদান): তিনি শুধু নবী ছিলেন না, ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষকও। কোরআনের ব্যাখ্যা, হালাল-হারামের জ্ঞান, নৈতিকতার শিক্ষা—সবই তিনি সাহাবাদের মাধ্যমে উম্মতের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।
তৃতীয়ত, আত্মশুদ্ধি (তাযকিয়া): তিনি তাঁর অনুসারীদের আত্মিক পরিশুদ্ধির শিক্ষা দিয়েছেন। অহংকার, হিংসা, লোভ, অন্যায়—এসব থেকে মুক্ত হয়ে হৃদয়কে কলুষমুক্ত করার দীক্ষা দিয়েছেন।
চতুর্থত, জি'হা'দ: তিনি অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। ইসলামের সুমহান আদর্শ প্রতিষ্ঠা ও মানবতার মুক্তির জন্য বিভিন্ন সময়ে জি'হা'দে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যেখানে ন্যায়বিচার ও শান্তির আদর্শ প্রতিষ্ঠা ছিল মূল লক্ষ্য।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য এক অনুপম আদর্শ। তাঁর এই চারটি প্রধান কাজের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, একটি আদর্শ সমাজ ও উন্নত চরিত্র গঠনের জন্য দাওয়াত, শিক্ষা, আত্মশুদ্ধি ও সংগ্রামের সমন্বয় অপরিহার্য। আর এই চার মূলনীতির উপর'ই চরমোনাই দরবার তথা তাদের সকল প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।
চরমোনাই দরবারের কার্যক্রম ও প্রতিষ্ঠানসমূহ
চরমোনাই দরবারের আওতায় বিভিন্ন ইসলামি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন পরিচালিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে
বাংলাদেশ মু'জা'হি'দ কমিটি (আধ্যাত্মিক উন্নয়নের জন্য)
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড)
ইসলামী শ্রমিক আন্দোলন
ইসলামী আইনজীবী পরিষদ
জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ
জাতীয় শিক্ষক ফোরাম
ইসলামী মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ
ইসলামী ছাত্র আন্দোলন
ইসলামী যুব আন্দোলন
ইসলামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম পরিষদ
বার্ষিক মাহফিল ও গণজমায়েত
চরমোনাই দরবারে প্রতি বছর দুটি বড় মাহফিল হয়:
অগ্রহায়ণ মাসে শীতকালীন মাহফিল
ফাল্গুন মাসে বৃহৎ মাহফিল (যেখানে প্রায় অর্ধকোটি মুসল্লি অংশ নেন)
এছাড়াও সারা বছর দেশে-বিদেশে দাওয়াতি সফর পরিচালিত হয়।
রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে চরমোনাই দরবারের ভূমিকা
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে চরমোনাই দরবার একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ রক্ষার পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিমালায় ইসলামি আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসলাম, দেশ ও মানবতা বিরোধী কার্যক্রমের প্রতিবাদে চরমোনাই দরবারের বিভিন্ন সংগঠন সরব ভূমিকা পালন করছে।
শেষ কথা
শতাব্দীকাল ধরে প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেও চরমোনাই দরবার আজও ইসলামের খেদমতে অটল রয়েছে। এটি শুধুমাত্র একটি দরবার নয়; বরং এটি দাওয়াত, শিক্ষা, আত্মশুদ্ধি ও সামাজিক বিপ্লবের এক অনন্য কেন্দ্র, যা ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
সাংবাদিক মাওলানা আসগর সালেহী
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।