মো: জিহাদ হোসেন
বিশেষ প্রতিনিধি চাঁদপুর।
চাঁদপুর জেলায় তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদের হার বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, অপরিণত বয়সে বিয়ে, দাম্পত্যজীবনে বনিবনার অভাব, যৌতুক ও তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহকে দায়ী করেছেন। গত এক বছরে জেলায় যতগুলো বিয়ে নিবন্ধন হয়েছে সেই সংখ্যার অনুপাতে ৪৮ শতাংশ বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। তাই পারিবারিক সচেতনতা বাড়ানো, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দিতে বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরকারি পরিসংখ্যানে চাঁদপুরে গড়ে প্রতিদিন তালাক হচ্ছে ২১টি করে। ব্যাপক হারে সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ হিসেবে যে চিত্র উঠে এসেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো অল্প বয়েসে বিয়ে, নারী নিযাতন, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বা পরকীয়, সামজিক মূল্যবোধের অভাব, পারিবারিক বন্ধনের ঘাটতি, যৌন অক্ষমতা আর সোস্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার।
জেলা রেজিস্ট্রার অফিসের তথ্য বলছে, গেলো এক বছরে চাঁদপুরের ৮ উপজেলায় বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়েছে ১৪৪৬৫টি। একই সময়ে তালাক বা বিচ্ছেদ হয়েছ ৭৮৯১টি, যা দিনের হিসেবে গড়ে ২১টিরও বেশি। বিবাহ বিচ্ছেদের হাড় বাড়ার হারকে আশংখা জনক বলছেন বিবাহ ও নিকাহ রেজিষ্ট্রাররা। তারা জানালেন মুখে মুখে করা বিয়ে এবং কাজী ছাড়া অপ্রাপ্ত ছেলে মেয়েদের রেজিস্ট্রেশন বিহীন গুলো বেশি ভাঙ্গছে।
জন সংখ্যার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যেমন বাড়ছে বিয়ে পাশাপাশি আশংকাজনক হারে বেড়েছে তালাক বা বিয়ে বিচ্ছেদ। সোনীলী স্বপ্ন নিয়ে শুরু হওয়া সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে তুচ্ছ কারণেই। বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা বৃদ্ধির হারকে লাগাম টানা যাচ্ছে না কোন ভাবেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যখন চরমভাবে বিরোধ দেখা দেয়, মিলেমিশে শান্তিপূর্ণভাবে জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন মধুর সম্পর্ক তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে ছিন্ন করা হয়। জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিবাহবিচ্ছেদের পেছনে বড় কারণগুলো হলো, পরকীয়ার মতো অবৈধ সম্পর্ক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে নিজেদের সিদ্ধান্তে বিয়ে, দাম্পত্যজীবনে বনিবনার অভাব, যৌতুক, বাল্যবিবাহ অন্যতম। অনেকে নিজে নিজে বিয়ে করলেও পরিবার শেষ পর্যন্ত সম্মতি না দেওয়ায় পারিবারিক কলহ বাড়ছে। এ ছাড়া কমছে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও অনুশাসন মানার প্রবণতা।
চাঁদপুরের বেশ কয়েকজন কাজী জানিয়েছেন, আগে তালাকের প্রধান কারণ ছিল দারিদ্র্যতা বা পারিবারিক ব্যয়বহনের অক্ষমতা। সেই সঙ্গে শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে দ্বন্দ্বের জের ধরে পারিবারিক অশান্তি থেকে তালাক। এ ছাড়া ছিল নানা কলহ-বিবাদের জেরে স্ত্রীকে নির্যাতন। এই সমস্যাগুলো যেসব এলাকায় অভাব-দারিদ্র্য বেশি সেসব এলাকায় বেশি হতো। অনেক ক্ষেত্রে গ্রামের দরিদ্র বাবা-মায়ের সন্তান লালন-পালনের সক্ষমতা কম থাকায় মেয়ে একটু বড় হলেই বিয়ে দিয়ে দিতেন। তুলনামূলক অনেক বেশি বয়সের স্বামীর ঘর করতে না পারায় হতো তালাক। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধর্মীয় অনুশাসন কমে গিয়ে নৈতিক অবক্ষয় বেড়ে যাওয়া, অবাধ তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক স্থাপনের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় তালাক বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বিবাহবিচ্ছেদ হয় বোঝাপড়ার অভাবে।
চাঁদপুর নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইবুনালের স্পেশাল পিপি এড. শিরিন সুলতানা মুক্তা বলেন, তালাক বা বিচ্ছেদ হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মেয়ে ও পরিবারের শিশু সন্তানরা। ক্রমাগত মানুষ হয়ে উঠছে অসহিষ্ণু, অমানবিক। বিচ্ছেদের আবেদনের পর দাম্পত্য সম্পক ফিরে পেতে সমঝোতা হয়েছে নগন্ন। নির্যাতন-পীড়ন থেকে আনেক নারীরা তালাকে খুঁজছেন মুক্তি। অনেকে আত্ম হণনে পথকে বেচে নিয়েছে। আবার সংসার টিকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে তালাক দিচ্ছেন অনেক পুরুষ জানালেন এই আইনজীবী।
চাঁদপুর পুলিশ সুপার মুহম্মদ আব্দুর রকিব জানান, বিবাহ বিচ্ছেদ প্রবাসীও ক্ষতি গ্রস্ত হচ্ছে। অনেক প্রবাসীর স্ত্রী অণ্যের হাত ধরে পালিয়ে যায়। পরিবারের পকআষ থেকে থানায় নিখোঁজ জিডি ও মামলা হলেও পরবর্তীতে সত্যতা পাওয়া যায় না। দেখায় প্রাপ্ত বয়স্ক নারী স্বেচ্ছায় ঘর এ জন্যে সচেতনার বিকল্প নেই বলে জানালেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।