নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড। অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় নিমজ্জিত এই প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের মাধ্যমে বেড়েছে উৎপাদন সক্ষমতা, কমেছে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যয়ের পরিমাণ। অদূর ভবিষ্যতে ইডিসিএল দেশের সরকারি ওষুধের চাহিদার সবটাই উৎপাদন ও সরবরাহের মাধ্যমে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, ইডিসিএল গত তিন মাসে নতুনভাবে উৎপাদিত দুটি ওষুধ সরবরাহের জন্য উৎপাদন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। ইডিসিএল বর্তমানে৫৫টি ওষুধ উৎপাদন করে, যা একশটিতে উন্নীত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
উন্নয়ন কার্যক্রম: প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসায় সব কার্যক্রমে পরিবর্তন এসেছে। এরই মধ্যে ঢাকা কারখানায় তিতাস গ্যাস আরএমএস সার্ভিসিং এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার করে গ্যাসের চাপ ও সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাওয়া জায়গায় নতুন পানির মিটার স্থাপন করা হয়েছে এবং ঢাকা কারখানায় ৪৫ হাজার লিটার বা ঘণ্টা ক্ষমতাসম্পন্ন গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যমান এইচভিএসি সমূহের রক্ষণাবেক্ষণ এবং লিফট রক্ষণাবেক্ষণের কাজ বাইরের ঠিকাদারের পরিবর্তে প্রকৌশল বিভাগ নিজেরাই করছে।
ঢাকায় কারখানায় স্যুয়ারেজ পরিশোধন প্রকল্প স্থাপনের কাজ চলছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বিধি অনুযায়ী আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার প্রথম ধাপ শেষ করে দ্বিতীয় ধাপের কাজ শুরু হয়েছে। পুরোনো পেনিসিলিন ইউনিটের সংস্কার ও নতুন সলিড ডোজেজ ইউনিট স্থাপন করে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর কাজ প্রায় শেষের দিকে। ওষুধের গুণগত মান বাড়াতে একটি অয়েল, ডাস্ট ও ময়েশ্চার ফ্রি নতুন স্ক্রু এয়ার কম্প্রেসর স্থাপনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
বগুড়া কারখানায় সিসি কিটস প্যাকেজিংয়ের জন্য ৬ হাজার বর্গফুটের একটি ভবন স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদনের জন্য ৫০০ কেভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন আরেকটি নতুন ডিজেল জেনারেটর কেনার প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়া ১০ কেজি বা ঘণ্টা ক্ষমতাসম্পন্ন একটি নতুন ইনসিনারেটর স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বগুড়া কারখানায় নতুন কিউব ব্লেন্ডার মেশিন, ট্যাবলেট কম্প্রেসন মেশিন, ট্যাবলেট কোটিং মেশিন, কম্বিপ্যাক ব্লিস্টার প্যাকিং মেশিন ক্রয় এবং সংযোজন করে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বগুড়া ও খুলনা কারখানায় কর্মরতদের জীবন ও মালপত্রের রক্ষার্থে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বিধি অনুযায়ী আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
খুলনা কারখানায় বিদ্যমান কনডম উৎপাদন ব্যবস্থাসহ হ্যান্ড গ্লাভস, ডিস্পোজেবল সিরিঞ্জ, ব্লাড ব্যাগ, ক্যাথেটার ও অন্যান্য এসেনসিয়াল মেডিকেল ডিভাইস উৎপাদন এবং সংরক্ষণের পর্যাপ্ত সুবিধাসহ আধুনিক ও পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল ডিভাইস উৎপাদন ইউনিট প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করা হয়েছে। পাশাপাশি প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়াল উৎপাদন ইউনিট স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কনডম প্লান্টের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের মাধ্যমে অ্যামোনিয়ামুক্ত স্বাস্থ্যোপযোগী পরিবেশ নিশ্চিতে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। খুলনা প্লান্ট আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণে পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল ডিভাইস উৎপাদন ইউনিট প্রতিষ্ঠার পর বিদ্যমান কনডম উৎপাদন ব্যবস্থাকে স্থানান্তর করে ওই স্থানে অন্যান্য ফেসিলিটিজ নির্মাণ করা হবে। প্রস্তাবিত খুলনা প্লান্টে আলট্রাসাউন্ড জেল, ড্রাই সিরাপ, ওরাল স্যালাইন, পাউডার ফর সাসপেনশন, ক্যাথেটার ব্যাগ, ব্লাড ব্যাগ, সাপোজিটরি, ট্যাবলেট, ক্যাপসুল প্রভৃতি উৎপাদনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
গোপালগঞ্জে স্থাপিত তৃতীয় কারখানা সফলতার সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে ওষুধ উৎপাদন করছে। সেইসঙ্গে জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল উৎপাদনের লক্ষ্যে কন্ট্রাসেপটিভউৎপাদন ইউনিটটি প্রস্তুত করা হয়েছে।
অর্জন: বিগত মাসগুলোয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর অনলাইন রিটার্ন সার্ভারে নির্ভুলভাবে ও সঠিক সময়ে অনলাইন ভ্যাট রিটার্ন জমা প্রদান করায় ইডিসিএল সর্বোচ্চ মূল্য সংযোজন করদাতার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে। কর্মীদের কারিগরি দক্ষতা উন্নয়নে ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে ৩২টি বিএমআর, বিপিআর এবং এসওপি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। গোপালগঞ্জ কারখানায়
জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী উৎপাদনের ইউনিট চালু করা হয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে জন্মনিয়ন্ত্রণ ট্যাবলেট সরবরাহের দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচিত হয়েছে। নতুন পণ্য উৎপাদন: অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট ৭৫ মি. গ্রা. ডিজিডিএ থেকে অনুমোদিত হয়েছে, যা শিগগিরই উৎপাদন শুরু হবে। এ ছাড়া মক্সিফ্লক্সসিন চোখের ড্রপ ০.৫% ডব্লিউ/ভি, টেনটেটিভ ১০০ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অন্তর্ভুক্ত ওষুধগুলো উৎপাদনের জন্য কাজ চলমান আছে। আরও দশটি পণ্য বগুড়া কারখানার জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে অনুমোদন হয়েছে: অ্যামলোডিপিন ট্যাবলেট ৫মি. গ্রা; এটোরভাসটাটিন ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট ১০ মি.গ্রা; ক্যাল সিয়াম ট্যাবলেট ৫০০ মি.গ্রা.; ফেক্সোফেনাডিন হাইড্রোক্লোরাইড ট্যাবলেট ১২০মি.গ্রা., গ্লিক্লাজাইড ট্যাবলেট ৮০মি. গ্রা; লোসারটান পটাশিয়াম ট্যাবলেট ৫০মি.গ্রা; মেটফরমিন ট্যাবলেট ৫০০মি.গ্রা; জিঙ্ক ডিসপারসিবল ট্যাবলেট ২০মি.গ্রা।
নিরাপত্তা: প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পয়েন্টে নতুন করে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের মাধ্যমে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ঢাকা অফিসের ভান্ডার বিভাগ এবং নাসরিন টাওয়ার গোডাউনে পর্যাপ্ত সিকিউরিটি ব্যবস্থা প্রদানের লক্ষ্যে নতুন করে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এস্টাবলিশমেন্ট অব এসেনসিয়াল বায়োটেক অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার প্রকল্পের আর্থিক সংস্থানের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ইডিসিএলের ঋণ সহায়ক চুক্তি প্রস্তাবনাটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি জমি বরাদ্দের বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জমি বরাদ্দ হলে জরুরি ভিত্তিতে কার্যক্রম শুরু হবে। এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড, ঢাকা প্লান্ট স্থানান্তরের জন্য মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক দপ্তরে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য দলিলাদিসহ আবেদন করা হয়েছিল। পরে ওই স্থানে জমির আবেদন নামঞ্জুর হওয়ায় নতুন জমি বরাদ্দের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। জমি প্রাপ্তি সাপেক্ষে কার্যাবলি শুরু করা হবে। প্যাকেজিং ম্যাটারিয়াল ইউনিট প্রতিষ্ঠায় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বর্তমানে প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব তৈরিতে সব পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি নিয়োগ ইডিসিএলের তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পরবর্তী সময়ে সরকারি, বিদেশি বা নিজস্ব অর্থায়নে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
টেন্ডারে অধিকসংখ্যক দরদাতা যাতে অংশগ্রহণ করতে পারে সে জন্য অধিক উৎপাদক বা সরবরাহকারীকে তালিকাভুক্তি করা হয়েছে। এতে পূর্বের চেয়ে তালিকাভুক্ত উৎপাদক বা সরবরাহকারীর সংখ্যা ৮৯ থেকে ১২৭-তে উন্নীত হয়েছে। বাজার দর যাচাইয়ের মাধ্যমে সঠিক মানের পণ্য প্রকৃত মূল্যে কেনাকাটার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এসব বিষয়ে ইডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আ. সামাদ মৃধা বলেন, ইডিসিএলের মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানে কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে ইডিসিএলের নতুন টিকা উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ প্রক্রিয়া পুরোদমে চলছে, যা ২০২৭ সালের মধ্যে চালু হবে। গোপালগঞ্জে কন্ট্রাসেপটিভ এবং স্যালাইন উৎপাদন শুরু হতে যাচ্ছে। অতিরিক্ত জনবল কমানোয় বেতন-ভাতার ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানের ক্রয়-সংক্রান্ত নজরদারি জোরদার করা হয়েছে, ফলে স্থানীয় ও আমদানি উভয়ক্ষেত্রেই মোড়ক, কাঁচামাল, প্রকৌশল সামগ্রী ক্রয়, স্টেশনারি ও অন্যান্য ক্রয়, ডাইনিং-সংক্রান্ত ব্যয়সহ সার্বিক খরচের হার এরই মধ্যে কমিয়ে তিন মাসে প্রায় ২০ কোটি টাকা সাশ্রয় করা হয়েছে। এতে কিছু ওষুধের দাম কমানো সম্ভব হয়েছে। মো. আ. সামাদ মৃধা বলেন, ঢাকা, খুলনা ও বগুড়া প্রকল্পের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের কাজ চলছে। প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে সম্পন্ন হলে ইডিসিএল সরকারের ওষুধের চাহিদা পরিপূর্ণভাবে পূরণ করা সম্ভব হবে