মোঃ ছামছুজ্জামান রিয়াদ বদরগঞ্জ প্রতিনিধি রংপুর
রংপুর জেলা জুড়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে অনলাইন জুয়া বা ‘ক্যাসিনো’র আসক্তি। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত এর বিস্তার এতটাই ব্যাপক যে, বিভিন্ন বয়সের মানুষ—রিকশাচালক থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, ছাত্র, এমনকি শিক্ষক পর্যন্ত এই সর্বনাশা জুয়ায় জড়িয়ে পড়ছে। টাকার নেশায় উন্মত্ত হয়ে যুবসমাজ আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে, বাড়ছে চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির মতো অপরাধ।
অনলাইন জুয়ার এই আসক্তি মূলত টিকটক লাইভে জুয়া খেলা, বাজি ডটকম এবং ১এক্সবেট-এর মতো বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও অ্যাপের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। সহজ উপায়ে দ্রুত অর্থ উপার্জনের লোভে পড়ে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কিশোররাও এই ভয়ংকর নেশায় আসক্ত হচ্ছে। পরিস্থিতি এতটাই উদ্বেগজনক যে, সচেতন মহল এটিকে মাদকের চেয়েও ক্ষতিকর বলে আখ্যায়িত করছে। কারণ এটি কেবল আর্থিক সর্বনাশই ডেকে আনছে না, বরং মানসিক বিকার, পারিবারিক অশান্তি এবং সামাজিক অপরাধও আশঙ্কাজনকভাবে বাড়িয়ে তুলছে।
অনলাইন জুয়ার ভয়াবহ পরিণতি
একসময় জুয়া নির্দিষ্ট কিছু স্থানে সীমাবদ্ধ থাকলেও, স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা একে সবার হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। এর ফলে সমাজের প্রতিটি স্তরে এর বিষাক্ত প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই দ্রুত ধনী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে সামান্য পুঁজি থেকে শুরু করে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। যখন টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে, তখন তারা পরিবার, বন্ধু-বান্ধব এমনকি সুদের ওপর টাকা নিয়েও জুয়া খেলে যাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত যখন সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন, তখন চুরি, ছিনতাই, এবং ডাকাতির মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। এর ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে এবং সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে।
আইনের কড়াকড়ি সত্ত্বেও জুয়া চলছে
বাংলাদেশে জুয়া খেলার বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকলেও, অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এর বিস্তার রোধ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। ১৮৬৭ সালের জুয়া আইনে সর্বোচ্চ ৩ মাস জেল বা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। এছাড়া, ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনলাইনে জুয়া ছড়ানোর জন্য ৫ থেকে ১০ বছরের জেল এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে এই অর্থ লেনদেনের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।
তবে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এই অনলাইন জুয়ার লাগাম টেনে ধরতে হিমশিম খাচ্ছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হওয়ায় এবং বিভিন্ন জটিল কৌশলের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন হওয়ায় তাদের শনাক্ত করা ও আইনের আওতায় আনা চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমাধানের পথ কী?
সচেতন মহল এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করছেন, এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। শুধু আইন প্রয়োগ নয়, এর পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং যুবসমাজকে অনলাইন জুয়ার কুফল সম্পর্কে অবহিত করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা যেতে পারে এবং গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করে তোলা যেতে পারে। এছাড়া, অনলাইন জুয়ার ওয়েবসাইট এবং অ্যাপ্লিকেশনগুলো ব্লক করার পাশাপাশি অবৈধ লেনদেনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
অনলাইন জুয়ার এই সর্বগ্রাসী থাবা থেকে রংপুর তথা পুরো দেশের যুবসমাজকে রক্ষা করতে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ না করলে অদূর ভবিষ্যতে এর পরিণতি আরও ভয়াবহ হতে পারে